রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন

পবিত্র আশুরা ও এর ফজিলত

মেঘনার আলো ২৪ ডেস্ক / ১৩৫ বার পঠিত
আপডেট : সোমবার, ১৫ জুলাই, ২০২৪, ২:৪৫ অপরাহ্ণ

 

পবিত্র জিলহজ্ব মাস শেষ হয়ে আমাদের মাঝে এসেছে মুহাররম মাস। হয়ে গেছে একটি বছরের বিদায়, আর একটি বছরের সূচনা। পশ্চিমাকাশে হেসে উঠবে মুহাররমের হেলাল- নতুন বছরের নতুন চাঁদ। জগদ বাসী কে ডেকে বলবে- বিগত দিনের হিসাব মিলাও। প্রত্যয় গ্রহণ কর নতুন বছরের। পাথেয় সংগ্রহ কর পরকালের।

দিন যায় রাত আসে। সপ্তাহ পেরিয়ে মাস আসে। ধীরে ধীরে তা-ও ফুরিয়ে যায়। এভাবে বারটি মাস ঘুরতেই কেটে যায় একটি বছর। শুরু হয়ে যায় আবার নতুন বছরের আয়োজন। এভাবে একদিন নিভে আসে জীবন-বাতি। বুদ্ধিমান তো সে-ই যে জীবনের এ মূল্যবান সময়গুলো যথাযথ কাজে লাগায়।

প্রাত্যহিক জীবনে দিন-রাতের এ পরিক্রমা অনেকের কাছেই অনেকটা স্বাভাবিক। তবে জ্ঞানীদের জন্য এ থেকে শিক্ষা গ্রহণের বহু উপলক্ষ রয়েছে। কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা বিষয়টি বিভিন্নভাবে বোঝাতে চেয়েছেন। আল্লাহ তাআলা বলেন-

إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالأرْضِ وَاخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ لآياتٍ لأولِي الأَلْبَابِ .

নিশ্চয়ই আকাশম-ল ও পৃথিবীর সৃজনে এবং পালাক্রমে রাত-দিনের আগমনে বহু নিদর্শন আছে ওই সকল বুদ্ধিমানদের জন্য…। -সূরা আলে ইমরান (৩) : ১৯০

আল্লাহ তাআলা আরো বলেন-

إِنَّ فِي اخْتِلافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَمَا خَلَقَ اللهُ فِي السَّمَاوَاتِ والأرض لآياتٍ لِقَوْمٍ يَتَّقُونَ .

নিশ্চয়ই দিন-রাতের একের পর এক আগমনে এবং আল্লাহ আকাশম-লী ও পৃথিবীতে যা-কিছু সৃষ্টি করেছেন তাতে সেই সকল লোকের জন্য বহু নিদর্শন উপস্থিত রয়েছে, যাদের অন্তরে আছে অল্লাহর ভয়। -সূরা ইউনুস (১০) : ৬

আল্লাহ তাআলা আরো চমৎকার উপস্থাপনে বলেন-

تَبٰرَكَ الَّذِیْ جَعَلَ فِی السَّمَآءِ بُرُوْجًا وَّ جَعَلَ فِیْهَا سِرٰجًا وَّ قَمَرًا مُّنِیْرًا .وَ هُوَ الَّذِیْ جَعَلَ الَّیْلَ وَ النَّهَارَ خِلْفَةً لِّمَنْ اَرَادَ اَنْ یَّذَّكَّرَ اَوْ اَرَادَ شُكُوْرًا.

কত মহান সেই সত্তা, যিনি আসমানে ‘বুরূজ’ সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে স্থাপন করেছেন উজ্জ্বল প্রদীপ এবং আলো বিস্তারকারী চাঁদ। এবং তিনিই সেই সত্তা, যিনি রাত ও দিনকে পরস্পরের অনুগামী করে সৃষ্টি করেছেন; (কিন্তু এসব বিষয় উপকারে আসে কেবল) সেই ব্যক্তির জন্য, যে উপদেশ গ্রহণের ইচ্ছা রাখে কিংবা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করতে চায়। -সূরা ফুরকান (২৫) : ৬১, ৬২

তবে বাস্তব কথা হল, কেউ এ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে, কেউ করে না। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

كُلّ النّاسِ يَغْدُو فَبَايِعٌ نَفْسَهُ فَمُعْتِقُهَا أَوْ مُوبِقُهَا.

প্রতিটি মানুষ সকাল যাপন করে; অতঃপর নিজেকে বিক্রি করে। এভাবে কেউ নিজেকে (আল্লাহর আনুগত্যে নিয়োজিত করে জীবনকে ধ্বংস থেকে) রক্ষা করে। আর কেউ (নফস ও শয়তানের আনুগত্যে নিয়োজিত হয়ে) নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ২২৩

বুদ্ধিমান তো সেই, যে প্রতিটি নতুন সময় ও সূচনায় নিজেকে এমন কাজে নিয়োজিত করে, যার মাধ্যমে তার আখেরাত সুন্দর হয়। আর নির্বোধ ওই ব্যক্তি, যে নতুন সময় ও সূচনায় এমন কাজকর্মে লিপ্ত থাকে, যা তার ধ্বংস টেনে আনে। তাই জীবনের প্রতিটি নতুন মুহূর্তে কল্যাণের দিকে আরো ধাবিত হওয়ার প্রত্যয় গ্রহণ করাই মুমিনের ঈমানের দাবি। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক নসীব করুন।

মুহাররম : আল্লাহ্ তাআলার নির্ধারিত সম্মানিত মাস এবং হিজরী বর্ষের প্রথম মাস

হিজরী বর্ষের সর্বপ্রথম মাস- মুহাররামুল হারাম তথা মুহাররম মাস। হাদীসের ভাষায়- শাহরুল্লাহ আলমুহাররাম। আল্লাহ তাআলা বছরের যে ক’টি মাসকে বিশেষ মর্যাদায় মহিমান্বিত করেছেন মুহাররম তার অন্যতম। পবিত্র কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা বলেন-

اِنَّ عِدَّةَ الشُّهُوْرِ عِنْدَ اللهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِیْ كِتٰبِ اللهِ یَوْمَ خَلَقَ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضَ مِنْهَاۤ اَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ؕ ذٰلِكَ الدِّیْنُ الْقَیِّمُ. فَلَا تَظْلِمُوْا فِیْهِنَّ اَنْفُسَكُم …

আল্লাহ যেদিন আসমান যমীন সৃষ্টি করেছেন সেদিন থেকেই মাসসমূহের গণনা আল্লাহ তাআলার নিকট তাঁর বিধান মতে বারটি। তন্মধ্যে চারটি মাস সম্মানিত। এটাই সহজ-সরল দ্বীন (-এর দাবি) অতএব তোমরা এ দিনগুলোতে নিজের উপর জুলুম করো না।… -সূরা তাওবা (৯) : ৩৬

এ চার মাস কী কী? হাদীস শরীফে তা বলে দেওয়া হয়েছে। নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- সময়ের হিসাব যথাস্থানে ফিরে এসেছে, আসমান-যমীনের সৃষ্টির সময় যেমন ছিল। (কারণ, জাহেলী যুগে আরবরা নিজেদের স্বার্থ ও মর্জিমতো মাস-বছরের হিসাব কম-বেশি ও আগপিছ করে রেখেছিল।) বার মাসে এক বছর । এর মধ্য থেকে চারটি মাস সম্মানিত। তিনটি মাস ধারাবাহিক- যিলকদ, যিলহজ্ব ও মুহাররম। আরেকটি হল রজব, যা জুমাদাল আখিরাহ ও শাবানের মধ্যবর্তী মাস। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৬৬২

হাদীসে এ মাসকে শাহরুল্লাহ তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩

আরো ইরশাদ হয়েছে-

وَأَفْضَلُ الْأَشْهُرِ شَهْرُ اللهِ الَّذِي تَدْعُونَهُ الْمُحَرّمُ.

(রমযানের পর) শ্রেষ্ঠ মাস হচ্ছে আল্লাহর মাস, যাকে তোমরা মুহাররম বলে থাক। -সুনানে কুবরা, নাসাঈ, হাদীস ৪২১৬

প্রকৃতপক্ষে সকল মাসই তো আল্লাহর মাস। তথাপি এ মাসকে বিশেষভাবে ‘আল্লাহর মাস’ বলে ব্যক্ত করার মাঝে রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। যেমন পৃথিবীর সকল মসজিদই আল্লাহর ঘর। কিন্তু কাবা শরীফকে বিশেষভাবে বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর বলার হেকমত কী? কারণ এর রয়েছে বিশেষ মর্যাদা। তেমনি বছরের অন্যান্য মাস অপেক্ষা মুহাররমের রয়েছে বিশেষ গুরুত্ব।

আল্লাহ তাআলা কুরআন মাজীদে হিজরী সময়ের গুরুত্ব সম্পর্কে বলেছেন-

یَسْـَٔلُوْنَكَ عَنِ الْاَهِلَّةِ قُلْ هِیَ مَوَاقِیْتُ لِلنَّاسِ وَ الْحَجِّ.

লোকেরা আপনার কাছে নতুন চাঁদ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আপনি তাদেরকে বলে দিন, এটা মানুষের (বিভিন্ন কাজ-কর্মের) হিসাব এবং হজ্বের সময় নির্ধারণ করার জন্য। -সূরা বাকারা (২) : ১৮৯

মুসলমানদের বহু দ্বীনী বিষয়, বিশেষ করে হজ্বের মতো মহিমান্বিত আমল নির্ভরশীল চাঁদের হিসাবের উপর। আরবী মাস-বছরকে ঘিরে ইসলামের বহু বিধান আবর্তিত হয়। এই আরবী হিজরী চান্দ্রবর্ষের প্রথম মাসটিই হচ্ছে মুহাররম। মুহাররমকে ঘিরেও রয়েছে শরীয়তের সুন্দর সুন্দর বিধান ও আমল। ফলে দ্বীনী দায়িত্ববোধ থেকেই হিজরী মাস-বর্ষের গণনা এবং এর শুরু-শেষের হিসাবের প্রতি যত্নবান হওয়া মুমিনের জন্য সবিশেষ কাম্য।

নতুন চাঁদ নতুন প্রত্যয়, দুআ পড়ে নিই নতুন বছরের

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নতুন চাঁদ দেখে এই দুআ পড়তেন-

اللهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْيُمْنِ وَالْإِيمَانِ، وَالسَّلامَةِ وَالْإِسْلامِ، رَبِّي وَرَبُّكَ اللهُ.

আয় আল্লাহ, আপনি এই হিলালকে আমাদের জন্য ঈমান ও ইসলাম এবং শান্তি ও বরকতের সঙ্গে উদিত করুন। আমার ও তোমার রব আল্লাহ। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৩৪৫১; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ১৩৯৭

এ দুআটি যে কোনো মাসের নতুন চাঁদ দেখে পড়ার জন্য। এ হিসাবে যদি মুহাররমের চাঁদ দেখে এ দুআ পড়া হয় তাহলে নতুন চাঁদের সাথে সাথে নতুন বছরের দুআও হয়ে যাবে।

অবশ্য ইমাম আবুল কাছেম বাগাভী রাহ. (৩১৭ হি.) ‘মু‘জামুস সাহাবা’ কিতাবে সহীহ সনদে নতুন মাস ও নতুন বছরের শুরুতে পড়ার একটি দুআ উল্লেখ করেছেন। সাহাবী আবদুল্লাহ বিন হিশাম রা. বলেন, সাহাবায়ে কেরাম নতুন মাস বা নতুন বছর শুরুর এ দুআটি তেমন গুরুত্ব দিয়ে শিখতেন, যেভাবে কুরআনুল কারীম শিখতেন। দুআটি হল-

اللّهُمَّ أَدْخِلْهُ عَلَيْنَا بِالأَمْنِ وَالِإيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَالإِسْلَامِ وَجِوَارٍ مِنَ الشَّيطَانِ وَرِضوَانٍ مِنَ الرَّحْمنِ.

(قال الحافظ ابن حجر في الإصابة : وهذا موقوف على شرط الصحيح.)

হে আল্লাহ! আপনি আমাদের মাঝে এ মাস/বছরের আগমন ঘটান- শান্তি ও নিরাপত্তা এবং ঈমান ও ইসলামের (উপর অবিচলতার) সাথে; শয়তান থেকে সুরক্ষা ও দয়াময় আল্লাহর সন্তুষ্টির সাথে। (দ্রষ্টব্য : মুজামুস সাহাবাহ ৩/৫৪৩, বর্ণনা ১৫৩৯; আলইসাবাহ ৪/২৫৬)

এ দুআর ক্ষেত্রে স্পষ্ট বলা হয়েছে- এটি নতুন বছরের দুআ। আর সাহাবায়ে কেরামও এ দুআটির প্রতি খুব গুরুত্ব দিতেন।

অতএব ঈমান-ইসলাম, শান্তি-নিরাপত্তা ও রহমত-বরকতের সাথে কীভাবে আমার নতুন বছরটি অতিবাহিত হতে পারে- এ ব্যাপারে সচেষ্ট থাকাই হচ্ছে নতুন চাঁদের বার্তা। বিশেষ করে শয়তানের পথ পরিহার করে আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টির পথ অবলম্বন করা এবং নিজের ঈমানী যিন্দেগী প্রাণবন্ত করে তোলাই হবে আমার আগামী দিনের প্রত্যয়। তাই এখনই সংকল্পবদ্ধ হই- আমার ঈমান-আমল, স্বভাব-চরিত্র, চিন্তা-দর্শন, মন-মানসিকতা, বোধ-উপলব্ধি সর্বোপরি একজন মুমিন-মুসলমান হিসাবে আমার জীবন যাপন যেন বিগত দিনের তুলনায় আরো বেগবান, ফলপ্রসূ, সমৃদ্ধ এবং সাফল্যমণ্ডিত হয়।

এ মাসে মনোযোগী হই রোযার প্রতি

পূর্বেই আমরা যে হাদীসটি উল্লেখ করে এসেছি- হযরত আবু হুরাইরা রা. থেকে বর্ণিত, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

أَفْضَلُ الصِّيَامِ، بَعْدَ رَمَضَانَ، شَهْرُ اللهِ الْمُحَرّمُ، وَأَفْضَلُ الصَلَاةِ، بَعْدَ الْفَرِيضَةِ، صَلَاةُ اللّيْلِ.

রমযানের পর সবচে উত্তম রোযা হল আল্লাহর মাস মুহাররমের রোযা। আর ফরয নামাযের পর সবচে উত্তম নামায হল রাতের নামায (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের নামায)। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬৩

এ হাদীস থেকে মুহাররমের ব্যাপারে দুটি কথা পাওয়া যায় :

এক. মুহাররম মাস আল্লাহর মাস। সম্মানিত ও মহিমান্বিত মাস।

দুই. এর সম্মান রক্ষা এবং এ থেকে যথাযথ উপকৃত হওয়ার একটি মাধ্যম হচ্ছে, এ মাসে রোযা রাখার প্রতি যত্নবান হওয়া।

কাজেই মুহাররম মাসে রোযা রাখার প্রতি আমরা মনোযোগী হতে পারি। বিশেষ করে দশ মুহাররম আশুরার রোযার কথা তো হাদীসে গুরুত্বের সাথেই উল্লেখ করা হয়েছে। এর প্রতিও আমরা বিশেষভাবে খেয়াল রাখব।

এ মাসে গুরুত্ব দেই তাওবার প্রতি

তাওবা-ইস্তিগফার যে কোনো সময়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। বান্দা আল্লাহর দরবারে ধরনা দেবে এবং নিজের অতীতের জন্য ক্ষমা চাইবে- এতেই তো তার বন্দেগীর শান। তবে কিছু কিছু মুহূর্ত এমন রয়েছে, যখন তাওবার পরিবেশ আরো অনুকূল হয়। বান্দার উচিত আল্লাহর দেওয়া সেই প্রত্যাশিত মুহূর্তগুলো লুফে নেওয়া এবং আল্লাহমুখী হয়ে জীবনকে আরো সুন্দর করা। মুহাররমের এ মাসটি, বিশেষ করে এর দশ তারিখ- ‘ইয়াওমে আশুরা’ এমনই একটি উপযুক্ত সময়।

মুহাররমের ফযীলতের একটি দিক হচ্ছে, এর সাথে তাওবা কবুল হওয়া এবং আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মুক্তি, নিরাপত্তা এবং গায়েবী সাহায্য লাভ করার ইতিহাস জুড়ে আছে। এজন্য এ সময়ে এমন সব আমলের প্রতি মনোনিবেশ করা উচিত, যাতে আল্লাহর রহমত বান্দার প্রতি আরো বেশি ধাবিত হয়। বিশেষভাবে এ সময়ে তাওবা-ইস্তিগফারের প্রতি পূর্ণ মনোযোগী হওয়া চাই।

এক সাহাবী নবীজীর কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন-

يَا رَسُولَ اللهِ، أَيّ شَهْرٍ تَأْمُرُنِي أَنْ أَصُومَ بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَان.

ইয়া রাসূলাল্লাহ! রমযানের পর আপনি কোন্ মাসে রোযা রাখতে বলেন? নবীজী বললেন-

إِنْ كُنْتَ صَائِمًا بَعْدَ شَهْرِ رَمَضَانَ فَصُمُ الْمُحَرّمَ، فَإِنّهُ شَهْرُ اللهِ، فِيهِ يَوْمٌ تَابَ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ، وَيَتُوبُ فِيهِ عَلَى قَوْمٍ آخَرِينَ.

قال الترمذي : هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ غَرِيبٌ.

তুমি যদি রমযানের পর রোযা রাখতে চাও তাহলে মুহাররমে রোযা রেখ। কেননা মুহাররম হচ্ছে আল্লাহর মাস। এ মাসে এমন একদিন আছে, যেদিন আল্লাহ তাআলা (অতীতে) অনেকের তাওবা কবুল করেছেন। ভবিষ্যতেও অনেকের তাওবা কবুল করবেন। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৪১

মুহাদ্দিসীনে কেরাম এ দিনটি আশুরার দিন হওয়ার সম্ভাবনা উল্লেখ করেছেন। দ্রষ্টব্য : লাতাইফুল মাআরেফ, পৃ. ৭৬

বান্দা তার নিজের ভাষায় রবের কাছে আকুতি পেশ করবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আল্লাহ তাআলার অপার অনুগ্রহ, তিনি সেই আকুতি পেশ করার অর্থবহ শব্দ-বাক্যও বান্দাকে শিখিয়ে দিয়েছেন। কুরআন-সুন্নাহ্য় বর্ণিত সেই মাসনূন দুআগুলোর মর্ম ও ব্যঞ্জনা প্রতিটি মুমিনের হৃদয় ছুঁয়ে যায়, যদি সে উপলব্ধির সাথে সেগুলো পাঠ করে। কুরআনে কারীমে আম্বিয়ায়ে কেরামের দুআ উল্লেখ করা হয়েছে, যে ওসিলায় তাঁরা আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত প্রাপ্ত হয়েছেন। মুমিনের জন্য সেগুলো অনেক বড় সম্বল। হাদীসেও অনেক দুআ-ইস্তিগফার বর্ণিত হয়েছে। এর মধ্যে ‘সায়্যেদুল ইস্তিগফার’কে আমরা আমাদের ওজীফা বানাতে পারি। সায়্যেদুল ইস্তিগফার হচ্ছে-

اللّهُمّ أَنْتَ رَبِّي لاَ إِلهَ إِلّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلَى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيّ، وَأَبُوءُ لَكَ بِذَنْبِي فَاغْفِرْ لِي، فَإِنّهُ لاَ يَغْفِرُ الذّنُوبَ إِلّا أَنْتَ.

হে আল্লাহ! আপনি আমার প্রতিপালক। আপনি ছাড়া কোনও মাবুদ নেই। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দা। আমি যথাসাধ্য আপনার সাথে কৃত অঙ্গীকার ও আপনার প্রতিশ্রুতির উপর রয়েছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার আশ্রয় গ্রহণ করছি। আমার প্রতি আপনার নিআমতের কথা স্বীকার করছি। আপনার কাছে আমি আমার গোনাহের কথা স্বীকার করছি। কাজেই আপনি আমাকে ক্ষমা করে দিন। নিশ্চয় আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৬৩০৬

এছাড়া কুরআন-হাদীসে আরো অনেক তাৎপর্যমণ্ডিত দুআ-ইস্তিগফার উল্লেখিত হয়েছে। আমরা সেগুলোও ওজীফা হিসাবে গ্রহণ করতে পারি। অন্তত মাঝে মাঝে হলেও উপলব্ধির সাথে সেগুলো পাঠ করা চাই।

দশ মুহাররম ‘ইয়াওমে আশুরা’ : গুরুত্ব ফযীলত এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

মুহাররম মাসের সবচে মহিমান্বিত দিন হচ্ছে ‘ইয়াওমে আশুরা’ তথা মুহাররমের দশ তারিখ। হাদীসে আশুরার দিনের অনেক ফযীলত বিবৃত হয়েছে। এমনকি ইসলামপূর্ব আরব জাহেলী সমাজে এবং আহলে কিতাব- ইহুদী-নাসারাদের মাঝেও ছিল এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা।

উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. বলেন-

كَانُوا يَصُومُونَ عَاشُورَاءَ قَبْلَ أَنْ يُفْرَضَ رَمَضَانُ، وَكَانَ يَوْمًا تُسْتَرُ فِيهِ الكَعْبَةُ، فَلَمّا فَرَضَ اللهُ رَمَضَانَ، قَالَ رَسُولُ الله صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: مَنْ شَاءَ أَنْ يَصُومَهُ فَلْيَصُمْهُ، وَمَنْ شَاءَ أَنْ يَتْرُكَهُ فَلْيَتْرُكْهُ.

(জাহেলী সমাজে) লোকেরা রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে আশুরার দিন রোযা রাখত। এ দিন কাবায় গেলাফ জড়ানো হত। এরপর যখন রমযানের রোযা ফরয হল তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যে এ দিন রোযা রাখতে চায় সে রাখুক। যে না চায় না রাখুক। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৫৯২

এ হাদীসদ্বয় থেকে বুঝে আসে- জাহেলী সমাজে এ দিনের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। এ দিনে তারা কাবা শরীফে গেলাফ জড়াত। এ দিন তারা রোযা রাখত। নবীজীও এ দিন রোযা রাখতেন। হিজরতের পরও এ দিন রোযা রাখতেন। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পূর্বে এ দিনের রোযা ফরয ছিল। রমযানের রোযা ফরয হওয়ার পর এ দিন রোযা রাখা এখন মুস্তাহাব।

এরপর যখন রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হিজরত করে মদীনা মুনাওয়ারায় চলে আসেন দেখেন, মদীনার আহলে কিতাব ইহুদীরাও এ দিনে রোযা রাখছে। এ দিনকে তারা বিশেষভাবে উদ্যাপন করছে। নবীজী তাদের জিজ্ঞাসা করলেন-

مَا هَذَا الْيَوْمُ الّذِي تَصُومُونَهُ؟

এ দিনে তোমরা কী জন্য রোযা রাখছ? তারা বলল-

هَذَا يَوْمٌ عَظِيمٌ، أَنْجَى اللهُ فِيهِ مُوسَى وَقَوْمَهُ، وَغَرّقَ فِرْعَوْنَ وَقَوْمَهُ، فَصَامَهُ مُوسَى شُكْرًا، فَنَحْنُ نَصُومُهُ.

এটি একটি মর্যাদাপূর্ণ দিবস। আল্লাহ তাআলা এ দিনে হযরত মূসা আ. ও তাঁর কওমকে (ফেরাউনের কবল থেকে) মুক্তি দিয়েছেন। এবং ফেরাউনকে তার দলবলসহ (দরিয়ায়) নিমজ্জিত করেছেন। এরপর হযরত মূসা আ. এ দিনে শুকরিয়া আদায় স্বরূপ রোযা রাখতেন। তাই আমরাও রোযা রাখি।

নবীজী এ শুনে বললেন-

فَنَحْنُ أَحَقّ وَأَوْلَى بِمُوسَى مِنْكُمْ.

হযরত মূসা আ.-এর অনুসরণের ক্ষেত্রে তো আমরা তোমাদের চেয়ে অধিক হকদার। এরপর নবীজী নিজেও রোযা রাখলেন এবং অন্যদের রোযা রাখতে বললেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩০; সহীহ বুখারী, হাদীস ১১২৫, ৩৯৪৩

ইহুদীদের নিকট এ দিনটি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল, এ দিনটিকে তারা ঈদের মতো উদ্যাপন করত। হযরত আবু মূসা রা. থেকে বর্ণিত-

كَانَ يَوْمُ عَاشُورَاءَ يَوْمًا تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ، وَتَتّخِذُهُ عِيدًا، فَقَالَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ: صُومُوهُ أَنْتُمْ.

আশুরার দিন এমন একটি দিন, যে দিনকে ইহুদীরা সম্মান করত এবং এ দিনকে ঈদ হিসাবে গ্রহণ করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা এ দিনে রোযা রাখ। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩১

রোযা ও তাওবা : আশুরার বিশেষ আমল

আশুরার দিনের মূল ইবাদত হচ্ছে এ দিনের রোযা রাখা। পূর্ববর্তী হাদীসগুলোতে আমরা মাত্রই যা দেখে এলাম। এ দিনের রোযার ফযীলতের ব্যাপারে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

صِيَامُ يَوْمِ عَاشُورَاءَ، أَحْتَسِبُ عَلَى اللهِ أَنْ يُكَفِّرَ السَّنَةَ الَّتِي قَبْلَهُ.

আশুরার দিনের রোযার ব্যাপারে আমি আল্লাহর নিকট প্রত্যাশা রাখি, তিনি পূর্বের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ মাফ করে দেবেন। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৬২

হযরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন-

مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ يَتَحَرّى صِيَامَ يَوْمٍ فَضّلَهُ عَلَى غَيْرِهِ إِلّا هَذَا اليَوْمَ، يَوْمَ عَاشُورَاءَ، وَهَذَا الشّهْرَ يَعْنِي شَهْرَ رَمَضَانَ.

অর্থাৎ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আশুরার দিনের চেয়ে গুরুত্ব দিয়ে অন্য কোনো দিন রোযা রাখতে দেখিনি এবং রমযান মাস অপেক্ষা অন্য কোনো মাসে এত গুরুত্ব দিয়ে রোযা রাখতে দেখিনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ২০০৬; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩২

সাহাবায়ে কেরাম এ দিনে বাচ্চাদেরকেও রোযা রাখতে অভ্যস্ত করতেন। বিখ্যাত নারী সাহাবী হযরত রুবায়্যি‘ বিনতে মুআববিয রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার দিন সকালে আনসারদের এলাকায় লোক মারফত এ খবর পাঠালেন-

যে আজ সকালে খেয়েছে সে যেন সারাদিন আর না খায়। আর যে সকালে খায়নি সে যেন রোযা পূর্ণ করে।

ঐ নারী সাহাবী বলেন, এরপর থেকে আমরা নিজেরাও এ দিনে রোযা রাখতাম এবং আমাদের বাচ্চাদেরও রোযা রাখাতাম। তাদের জন্য আমরা খেলনা বানিয়ে রাখতাম। তারা খাবারের জন্য কান্নাকাটি করলে তাদেরকে খেলনা দিয়ে শান্ত করতাম। ইফতার পর্যন্ত এ নিয়ে তার সময় কেটে যেত। -সহীহ বুখারী, হাদীস ১৯৬০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৬

(সুবহানাল্লাহ! সাহাবায়ে কেরাম সন্তানদেরকে সেই শিশুকাল থেকেই কীভাবে তরবিয়ত করতে থাকতেন! আর মুমিন মায়েরা নিজেদের সন্তানদেরকে আমলে অভ্যস্ত করে গড়ে তোলার প্রতি কতটা সজাগ-সচেতন ছিলেন!!)

অতএব এ দিনে রোযা রাখার ব্যাপারে আমরা খুব ইহতিমাম করব।

এছাড়া এর সাথে যেহেতু মিশে আছে আল্লাহর রহমত ও নাজাত লাভের ইহিহাস, তাই এ দিনে কীভাবে আল্লাহর রহমত পেতে পারি এদিকে খুব খেয়াল রাখব। তেমনিভাবে যেহেতু গুনাহ মাফেরও ঘোষণা এসেছে এ দিনে, তাই তাওবা-ইস্তিগফারের প্রতিও খুব মনোযোগ দেব। আর একজন মুমিন তো রোযা অবস্থায় আল্লাহর রহমত লাভের অধিক প্রত্যাশী হয়।

যেভাবে রাখব আশুরার রোযা

এতক্ষণের আলোচনায় আশা করি এ বিষয়টি ফুটে উঠেছে, আশুরার দিন রোযা রাখা অত্যন্ত ফযীলতপূর্ণ একটি আমল। এ দিন রোযা রাখা মুস্তাহাব। তবে এরচে উত্তম হল, দশ মুহাররমের আগে বা পরে নয় বা এগার তারিখে একদিন অতিরিক্ত রোযা রাখা। নয় তারিখে রাখতে পারলে ভালো। কারণ হাদীসে নয় তারিখের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন আশুরার রোযা রাখছিলেন এবং অন্যদেরকে রোযা রাখতে বলেছিলেন তখন সাহাবীগণ বললেন-

يَا رَسُولَ اللهِ إِنّهُ يَوْمٌ تُعَظِّمُهُ الْيَهُودُ وَالنّصَارَى؟

ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ দিনকে তো ইহুদী-নাসারারা (খ্রিস্টানরা) সম্মান করে? তখন নবীজী বললেন-

فَإِذَا كَانَ الْعَامُ الْمُقْبِلُ إِنْ شَاءَ اللهُ صُمْنَا الْيَوْمَ التّاسِعَ قَالَ: فَلَمْ يَأْتِ الْعَامُ الْمُقْبِلُ، حَتّى تُوُفِّيَ رَسُولُ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ.

তাহলে আগামী বছর আমরা নয় তারিখেও রোযা রাখব- ইনশাআল্লাহ। কিন্তু সেই আগামী বছর আসার পূর্বেই নবীজীর ইন্তেকাল হয়ে যায়। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১১৩৪

‘নয় তারিখ রোযা রখব’ মানে দশ তারিখের সাথে নয় তারিখ মিলিয়ে রাখব। এজন্য ইবনে আব্বাস রা. বলতেন-

صُومُوا التّاسِعَ وَالعَاشِرَ وَخَالِفُوا اليَهُودَ.

তোমরা নয় তারিখ এবং দশ তারিখ রোযা রাখ এবং ইহুদীদের বিরোধিতা কর। -জামে তিরমিযী, হাদীস ৭৫৫

(একটু চিন্তা করুন তো, ইসলামী শরীয়তে বৈধ এবং কাম্য একটি ইবাদতের ক্ষেত্রে যদি এমন বিরোধিতার কথা আসে তাহলে ইহুদী-নাসারাদের নিজস্ব সভ্যতা-সংস্কৃতি এবং বিজাতীয় কালচারের ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করার বিধান কত কঠোর হতে পারে! )

আর সবচে উত্তম হয়, দশ তারিখের সাথে মিলিয়ে আগে-পরে আরো দুটি রোযা রাখা। নয়, দশ ও এগার সর্বমোট তিনটি রোযা রাখা। কারণ, পুরো মুহাররম মাসব্যাপি রোযার কথা তো সহীহ হাদীসেই আছে। (দ্রষ্টব্য : ফাতহুল বারী, ইবনে হাজার রাহ. ৪/২৪৬)
আশুরাঃ

আরবি ‘আশারা’ শব্দের শাব্দিক অর্থ ১০ বা দশম। আরবি ক্যালেন্ডারের হিজরি বর্ষের প্রথম মাস মহররমের ১০ তারি

আশুরার দিনের স্মরণিয় ঘটনা সংক্ষিপ্ত ভাবে উল্লেখ করা হলোঃ

১. এই দিনে আল্লাহ তা’আলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। আর এই দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে।

২. এ দিনে হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন। মহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ পাক আদম (আ.)-এর দোয়া কবুল করেন এবং এ দিনে তিনি স্ত্রী হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করেন।

৩. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর ১০ মহররম তিনি নৌকা থেকে ঈমানদারদের নিয়ে দুনিয়ায় অবতরণ করেন।

 

৪. হজরত ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।

৫. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন ।

৬. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তার ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ৪০ বছর পর ১০ মহররম পিতার সঙ্গে মিলিত হন।

৭. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম তারিখে।

 

৮. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তার দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদের পানিতে ডুবে মারা যায়।

৯. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাকে হত্যা করার চেষ্টা করলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ পাক তাকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন।

১০. মহররম মাসের ১০ তারিখ কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনার অবতারণা হয়। এদিন অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে ইমাম হোসাইন রাঃ কারবালা প্রান্তরে শাহাদাতবরণ করেন। তবে শেষ ঘটনাটির জন্য বাংলাদেশসহ মুসলিম বিশ্বে আশুরা দিবসটি বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।

কারবালার ইতিহাস

ইতিহাসে উল্লেখ আছে, ইসলামের সর্বশেষ ও শ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহম্মদ (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র হযরত ইমাম হাসান রাঃ ও হযরত ইমাম হোসাইন রাঃ দামেস্ক অধিপতি হযরত আমীরে মোয়াবিয়া রাঃ এর পুত্র এজিদের খলিফা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের প্রচেষ্টাকে কেন্দ্র করে কারবালা প্রান্তরে হৃদয় বিদারক হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়।

মহররম পর্বের বিষয়বস্তু হলো ইমাম হাসানের সাথে এজিদের বিরোধ, ইমাম হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা ও কারবালায় ইমাম হুসাইনকে হত্যা।

এর ইতিহাসে লেখা হয়েছে, আবদুল জব্বারের স্ত্রীর নাম জয়নাব। খুবই রূপবতী। মু‘আবিয়া রাঃ এর পুত্র ইয়াযীদ তাকে দেখে মুগ্ধ হয় এবং তাকে বিয়ে করতে চায়। ইয়াযীদের মা মারওয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করে এবং প্রলোভন দেখিয়ে জয়নাবের সঙ্গে আবদুল জব্বারের বিচ্ছেদের ব্যবস্থা করে। আবদুল জব্বার জয়নাবকে তালাক দেয়। এরপর ইয়াযীদ জয়নাবের কাছে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে দূত পাঠায়। পথে এ দূতের সঙ্গে ইমাম হাসানের সাক্ষাৎ হয়। ইমাম হাসান জয়নাবের কাছে তার পক্ষ থেকেও বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার জন্য দূতকে অনুরোধ করেন। জয়নাব ইয়াযীদের প্রস্তাব প্রত্যাখান করে এবং ইমাম হাসানের প্রস্তাব গ্রহণ করে। ইমাম হাসান জয়নাবকে বিয়ে করেন। ইয়াযীদ ক্রোধে ফেটে পড়ে। অন্যদিকে ইমাম হাসানের অপর স্ত্রী জায়েদা জয়নাবকে হিংসা করতে শুরু করে।

এর মধ্যে মু‘আবিয়া অসুস্থ হয়ে ইন্তেকাল করেন। ইয়াযীদ বাদশাহ হয়। সে মদিনার অধিবাসীদের তার আনুগত্য স্বীকার করার নির্দেশ দেয়। মদিনার অধিবাসীরা তা অস্বীকার করলে ইয়াযীদ মারওয়ানকে মদিনা আক্রমণের জন্য পাঠায়। মদিনার সেনাদলের সঙ্গে মারওয়ানের সেনাদলের যুদ্ধ হয় এবং মারওয়ান পরাজিত হয়। পরে মারওয়ান মায়মুনা নামের এক বৃদ্ধার সাথে ইমাম হাসানকে হত্যার ব্যাপারে ষড়যন্ত্র করে। মায়মুনা ইমাম হাসানের স্ত্রী জায়েদার মাধ্যমে বিষ প্রয়োগে ইমাম হাসানকে হত্যা করে। ইমাম হুসাইন এ হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন।

এদিকে কুফার শাসক উবায়দুল্লাহ ইবনে যিয়াদ (আবদুল্লাহ জেয়াদ) ধোঁকা দিয়ে ইমাম হুসাইনকে বন্দি করার জন্য বাহ্যিকভাবে ইমাম হুসাইনকে নেতা বলে স্বীকার করে এবং তাকে কুফায় আসার আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠায়। ইমাম হুসাইন কুফার অবস্থা যাচাইয়ের জন্য মুসলিম ইবনে আকীলকে পাঠান। মুসলিম কুফার ব্যাপারে ইতিবাচক পত্র পাঠানোর পর ইমাম ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে কুফার দিকে রওয়ানা হন। পথে তিনি মুসলিমের শাহাদাতের খবর পান। মুহররম মাসের আট তারিখে ইমাম হুসাইন কারবালার প্রান্তরে পৌঁছেন। এখানে ইয়াযীদের সেনাবাহিনী কর্তৃক অবরুদ্ধ হন। তারা ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দেয়। ইমামের পরিবার ও সাথীরা ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হয়ে পড়েন। এ অবস্থার মধ্যেও ইমাম হুসাইন তার মেয়ে সাকীনার সাথে ইমাম হাসানের ছেলে কাসেমের বিয়ে দেন। অবশেষে মুহররমের ১০ তারিখে ইয়াযীদের সেনাদলের সাথে যুদ্ধ করতে করতে ইমাম হুসাইন তার সব সঙ্গী-সাথীসহ শাহাদাত বরণ করেন।

কারবালা প্রান্তরের এ বিয়োগাত্মক ঘটনা বাংলা সাহিত্যে বিভিন্ন যায়গায় বিভিন্ন ভাবে উঠে এসেছে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার মহররম কবিতায় আশুরার দিনের সে ঘটনাকে তুলে ধরেছেন—

‘নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া –
আম্মা লাল তেরি খুন কিয়া খুনিয়া,
কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে?
সে কাঁদনে আসু আনে সিমারের ও ছোরাতে।
রুদ্র মাতম ওঠে দুনিয়া দামেস্কে –
জয়নালে পরালো এ খুনিয়ারা বেশ কে ?
হায় হায় হোসেনা ওঠে রোল ঝঞ্ঝায়,
তলোয়ার কেঁপে ওঠে এজিদের পাঞ্জায়
উন্ মাদ দুল দুল ছুটে ফেরে মদিনায়
আলীজাদা হোসেনের দেখা হেথা যদি পায়।

[মুফতি মাওলানা জাহিদুল ইসলাম ছালেহী
পরিচালক ও অধ্যক্ষ, দারুচ্ছুন্নাত হোসাইনিয়া দীনিয়া একাডেমি
খতিব,আল আমিন জামে মসজিদ
বিস্নুদী জি টি রোড, চাঁদপুর।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এ জাতীয় আরও খবর

এক ক্লিকে বিভাগের খবর